ত্রিপুরার নদ-নদী: তালিকা, উৎস ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসহ পূর্ণাঙ্গ গাইড (Rivers of Tripura: A Complete Guide with List, Details & Key Facts)

Join us on Social Media
ত্রিপুরার প্রধান নদ-নদীগুলো হলো:- ১.মনু, ২.খোয়াই, ৩.গোমতী, ৪.দেও, ৫.ধলাই, ৬.লুঙ্গাই, ৭.জুরি, ৮.মুহুরী, ৯.হাওড়া, ১০.ফেনী।
উল্লেখ্য:- ত্রিপুরার দীর্ঘতম নদী হল মনু নদী ও ক্ষুদ্রতম নদী হল হাওড়া নদী।
ত্রিপুরার নদ-নদী (Rivers of Tripura):
উত্তর -পূর্ব রাজ্যগুলির মধ্যে ত্রিপুরা ক্ষুদ্রতম । এই রাজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ ভূখণ্ড জুড়ে রয়েছে পাহাড়শ্রেণী, তরঙ্গায়িত টিলাভূমি আর অবশিষ্ট নদী -উপত্যকায় অবস্থিত সমভূমি ও লুঙ্গাভূমি। ত্রিপুরার পাহাড়শ্রেনীগুলো উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত বলে অধিকাংশ নদীসমূহও উত্তর ও দক্ষিণ প্রবাহিনী। নদীগুলির সামান্য অংশই নাব্য যা আবার সব ঋতুতে সমান নাব্য থাকে না যার দরুন অধিকাংশ নদীই নৌ -চলাচলের উপযোগী নয়। পাহাড় থেকে নেমে আসা অসংখ্য ছোট-বড়ো ছড়া বা জলধারা নদীগুলিকে পুষ্ট করেছে। ত্রিপুরার প্রধান নদীগুলো বার্ষিক ৭৯৩ মিলিয়ন ঘনমিটার জল প্রবাহ উৎপন্ন করে থাকে।
প্রবাহের দিক অনুযায়ী ত্রিপুরার নদ-নদী:-
- উত্তরবহিনী নদী– মনু, খোয়াই, ধলাই, লঙ্গাই ও জুড়ি।
- দক্ষিণবাহিনী নদী- মুহুরী ও ফেনী।
- পশ্চিমবাহিনী নদী– গোমতী, হাওড়া ও বিজয়।
ত্রিপুরার নদীগুলির উত্পত্তিস্থল:-
নদীর নাম | উত্পত্তিস্থল |
---|---|
গোমতী | আঠারমুড়া পাহাড় |
জুরি, দেও, লঙ্গাই | জম্পুই পাহাড় |
হাওড়া | বড়মুড়া |
মুহুরী | দেবতামুরা |
গোমতীর উপনদী সরমা | লংতরাই |
রাইমা, ধলাই, খোয়াই ও মনু | শাকান পাহাড় |
ত্রিপুরার নদীসমূহের দৈর্ঘ্য ও অববাহিকা:-
নদীসমূহের নাম | দৈর্ঘ্য (কিলোমিটার) | প্রধান অববাহিকা |
মনু | ১৬৭ | কৈলাশহর ও লংতরাই ভ্যালি |
খোয়াই | ১৬৬ | খোয়াই ও অমরপুর |
গোমতী | ১৩৩ | অমরপুর, গণ্ডাতুইসা, সোনামুড়া ও উদয়পুর |
দেও | ১৩২ | ধর্মনগর, কাঞ্চনপুর ও কৈলাশহর |
ধলাই | ১১৭ | খোয়াই ও কমলপুর |
লঙ্গাই | ৯৮ | ধর্মনগর |
জুরি | ৭৯ | ধর্মনগর |
মুহুরী | ৬৪ | অমরপুর ও বিলোনিয়া |
হাওড়া | ৫৩ | আগরতলা |
কোন শহর কোন নদীর তীরে অবস্থিত:-
কৈলাশহর | মনু নদীর তীরে |
কমলপুর | ধলাই নদীর তীরে |
সোনামুড়া/ উদয়পুর/ অমরপুর | গোমতী নদীর তীরে |
কাঞ্চনপুর | দেও নদীর তীরে |
আগরতলা | হাওড়া নদীর তীরে |
খোয়াই | খোয়াই নদীর তীরে |
তেলিয়ামুড়া | খোয়াই নদীর তীরে |
সাব্রুম | ফেনী নদীর তীরে |
বিলোনিয়া | মুহুরী নদীর তীরে |
ধর্মনগর | জুরি নদীর তীরে |

ত্রিপুরার নদীগুলির বিশদ বর্ণনা:-
০১. মনু নদী (Manu River)
এটি ত্রিপুরার সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী, যার দৈর্ঘ্য ১৬৭ কিলোমিটার (১০৪ মাইল)। এই নদী শাখান রেঞ্জ থেকে উত্পন্ন হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে কুমারঘাট ও কৈলাশহর হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে এটি বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার মধ্য দিয়ে সিলেট সমভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মনুমুখে কুশিয়ারা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। কথিত আছে হিন্দুশাস্ত্রকার মনু এই নদীর তীরে শিবপুজা করতেন বলে এই নদীর নাম হয়েছে মনু।
০২. খোয়াই নদী (Khowai River)
এটি ত্রিপুরার দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী, যার দৈর্ঘ্য ১৬৬ কিলোমিটার। এই নদী আঠারোমুড়া পাহাড়ের পূর্ব অংশ থেকে উত্পত্তি লাভ করে উত্তর -পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে সিলেট জেলার বাল্লা নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং পরবর্তীতে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়। ভারতের খোয়াই জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হাওয়ার দরুন ঐ এলাকার নামানুসারে নদীটির নামকরন করা হয় “খোয়াই”।
যদিও খোয়াই নদীর প্রাচীন নাম ছিল ক্ষমা বা ক্ষেমা। এই ক্ষেমা নামকরণের পেছনেও একটি জনপ্রবাদ বর্তমান রয়েছে। একবার এক ভিনদেশী বণিক তার নৌকা এই নদীর তীরে নোঙ্গর ফেলে খাসিয়াদের একটি পূজা উৎসব উপভোগ করছিল। ওই যুবকের রূপে মুগ্ধ হয়ে অভিজাত এক খাসিয়া কন্যা তাকে ভালবেসে বিয়ে করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু খাসিয়া সম্প্রদায় এই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের একজন যুবকের সাথে ঐ কন্যার বিবাহ দেয়। পরবর্তীতে ক্ষেমা বা ক্ষমা নামের ঐ খাসিয়া কন্যা এই নদীতে আত্মাহুতি দেয়, সেই থেকে এই নদীর নাম হয়ে যায় ক্ষেমা বা ক্ষমা।
০৩. গোমতী নদী (Gomati River)
এই নদী লংতরাই এবং আঠারোমুড়া রেঞ্জ থেকে উত্পন্ন হয়ে পশ্চিম দিকে অমরপুর এবং সোনামুড়া হয়ে কুমিল্লা জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ও পরবর্তীতে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়। এই নদীর দৈর্ঘ্য হল ১৩৩ কিলোমিটার। এই নদীর উপর ডম্বুরের কাছে একটি বাধ নির্মান করে হ্রদ গড়ে তুলা হয়, যেখানে ত্রিপুরার প্রথম জল-বিদূত্ কেন্দ্র গড়ে উঠে। এই নদী গঙ্গা নামে ও পূজিত হয়। গোমতীর দুইটি উপনদী রয়েছে যারা হল রাইমা ও সরমা।
০৪. দেও নদী (Deo River)
এই নদী জম্পুই পাহাড় থেকে উত্পন্ন হয়ে উত্তর দিকে ধর্মনগর, কাঞ্চনপুরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে মনু নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। এই নদীর দৈর্ঘ্য হল ১৩২ কিলোমিটার।
০৫. ধলাই নদী (Dhalai River)
এই নদীটি লংতরাই রেঞ্জ থেকে উত্পত্তি লাভ করে। পরবর্তীতে নদীটি উত্তরদিকে ধলাই ও খোয়াই জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং অবশেষে রাজনগর উপজেলার মনু নদীতে মিলিত হয়। এই নদীটির দৈর্ঘ্য হল ১১৭ কিলোমিটার।
০৬. লঙ্গাই নদী (Longai River)
জম্পুই পাহাড় থেকে উত্পত্তি লাভ করে নদীটি উত্তর দিকে ধর্মনগর শহর হয়ে আসামের করিমগঞ্জ জেলায় প্রবেশ করে ও পরবর্তীতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে হাকালুকী হাওরে মিশে যায়। হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ হাওর, যা এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। এই নদীটি দৈর্ঘ্যে ৯৮ কিলোমিটার।
০৭. জুরি নদী (Juri River)
এই ভারত বাংলাদেশের একটি আন্ত:সীমান্ত নদী। নদীটি জম্পুই পাহাড় থেকে উত্পত্তি লাভ করে উত্তর দিকে ধর্মনগর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কুশিয়ারা নদীর সাথে মিলিত হয়। এই নদীটি দৈর্ঘ্যে ৭৯ কিলোমিটার।
০৮. মুহুরী নদী (Muhuri River)
মুহুরী নদী দেবতামুড়া পাহাড় থেকে উত্পত্তি লাভ করে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফেনী নদীর সাথে মিলিত হয়। এই নদীটি ছোট ফেনী নামে ও পরিচিত। নদীটি দৈর্ঘ্যে ৬৪ কিলোমিটার।
০৯. হাওড়া নদী (Howrah River)
হাওড়া নদী পশ্চিম জেলা তথা ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার মূল নদী। এই নদীটি মূলত মধ্য ত্রিপুরার বড়মূড়া পাহাড় থেকে উত্পত্তি লাভ করে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে আগরতলা শহরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিতাস নদীর সাথে মিলিত হয়। ককবরক ভাষায় এই নদীটি “সাইদ্রা নদী” নামে পরিচিত। এটি ত্রিপুরার সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম নদী, যা দৈর্ঘ্যে মাত্র ৫৩ কিলোমিটার।
১০. ফেনী নদী (Feni River)
ত্রিপুরা সংলগ্ন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নেমে আসা আসলং, রাঙ্গাফেনী ও তেইনডাং নামে তিনটি ক্ষুদ্র পাহাড়ী উপনদী মিলিত হয়ে সৃষ্টি হয় ফেনী নদীর, যা সবরূম শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের সীমান্ত নদী হিসেবে ফেনী নদীর বিশেষ গুরত্ব বিদ্যমান রয়েছে। এই নদীর উপর মৈত্রী সেতু গড়ে তোলা হয় যা ৯ মার্চ ২০২১ এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন, যা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দিকে একটা বিশেষ পদক্ষেপ বলে গণ্য করা হয়।
